History

কীর্তিমানদের মৃত্যু নেই। অনাদিকাল থেকেই মানুষ মহৎ, কল্যাণকর ও উদ্ভাবনী কর্মের মাধ্যমে রয়েছেন অমর হয়ে। ১৯৬২ সাল অত্র এলাকার জন্য একটি ঐতিহাসিক বছর। তৎকালীন এলাকার সচেতন, মুরব্বী, জ্ঞানী, গুণী, সমাজ সেবকরা অনুধাবক করেছিলেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, জাতির বিবর্তনের মূল উৎস শিক্ষা। শিক্ষা মানব জীবনের সাথে বহমান এবং মানব জীবনের ক্রম বিকাশের সাথে অভিন্নভাবে যুক্ত। শিক্ষা এক যুগের অভিজ্ঞতা ও ভান্ডার অন্য যুগে বয়ে নিয়া যায়। সম্ভবত ঐ সমস্ত উপলব্ধি থেকেই স্ব-উদ্দ্যোগে ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তারা আজও স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন।

তখন পাকিস্তান আমল। আইয়ুব খানের শাসনের প্রথম দিক। ঐ সময় শ্রেনী বন্টন নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে আলোচনা চলছিল। তখনকার জেলা শিক্ষা অফিসার মুসলিম চৌধুরী পরামর্শ দিলেন ২নং ফুলসাইন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জুনিয়র স্কুল চালু করলে তিনি সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করবেন। সেই থেকেই অত্র এলাকার আবাল-বৃদ্ধ বনিতা কিভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা যায় তার জবন্য ঝাপিয়ে পড়েন। জুনিয়র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একজন গ্রাজুয়েট প্রয়োজন, ঐ সময় একজন গ্রাজুয়েট পাওয়া দুষ্কর ছিল। অত্র এলাকার মধ্যে ফুলসাইন্দ গ্রামের নবীটিল্লা নিবাসী হাজী আকবর আলী সাহেবের ছেলে মোঃ টুনু মিয়া সাহেব (জন্ম ১৯২১ সাল) গ্রাজুয়েট ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি ভাদেশ্বর নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাশ করে মুরারী চাঁদ কলেজ (এম.সি. কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাশ করেন। তখন ছিল ব্রিটিশ শাসন। জনাব টুনু মিয়া পূর্বভারতের শিলং- এ চাকুরীরত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর করাচীতেও চাকুরী করেন। এই সময় বাড়িতে আসা যাওয়ার মধ্যে জনাব টুনু মিয়ার প্রতি সবার দৃষ্টি পড়ে এবং এই সময়জুনিয়র স্কুল প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য তার উপর চাপ সৃষ্টি করেন। তখন তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। বড় বড় কাজেই তখন গ্রআজুয়েট পাওয়া যেতনা। আর এ কাজে তো পাওয়া অসম্ভব ছিল। তখন জনাব টুনু মিয়াকে (উনার ভাষায়) হাঁটতে, বসতে, খেতে, চলাফেরা করতে অর্থাৎ সকল সময় ভাই-বোন, চাচা-চাচী, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী তথা সমগ্র এলাকাবাসী একটি জুনিয়র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। ঐ সময় তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নাই। একদিন তিনি তার ওস্তাদ পীর মাওলানা রমিজ উদ্দিন সাহেবের বসায় যান। সেখানে গিয়ে আরো কয়েকজন বড় বড় আলেম দেখতে পান। টুনু মিয়া সাহেব বাসায় ঢুকতেই মাওলানা রমিজ উদ্দিন (লেনের সাব) সাহেব সকলকে বললেন আসুন আমরা একটা মোনাজাত করি। মোনাজাতে তিনি ফুলসাইন্দ গ্রামে একটি বিদ্যালয় খোলার এবং টুনু মিয়া সাহেব যাতে ঐ বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহন করার পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। এই থেকেই বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু। পর থেকেই সমগ্র এলাকাবাসীর পরামর্শ, নির্দেশনা ও সহযোগিতায় ১৯৬২ সালে বর্তমান ২নং ফুলসাইন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিন দিকে মাটি কেটে একটি কাঁচাঘর তৈরি করে সর্বমোট ১১জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ফুলসাইন্দ জুনিয়র বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। টুনু মিয়া সাহেব এলাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির সূতিকাগার, উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম। ক্লাস শুরু হল ১৯৬২ সালে ১১জন সৌভাগ্যবান শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের নাম – (১) সাবিত্রী কনা নাগ,  (২) বিকাশ কৃষ্ণ গোস্বামী, (৩) জোনার আলী,  (৪) হরেন্দ্র কুমার দাস, (৫) আব্দুল মুকিত (৬) কমর উদ্দিন,  (৭) সৈলেশ চন্দ্র দাশ,  (৮) আতিক উদ্দিন,  (৯) সালেহা খানম,  (১০) মতিউর রহমান ও  (১১) আব্দুল মন্নান খাঁন।

যে সমস্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ ১৯৬২ সালে অত্র অঞ্চলের মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বীপশিখা প্রজ্জ্বলন করে আলো ছড়িয়ে দিতে মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন অর্থাৎ যারা প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ছিলেন-  (১) প্রধান শিক্ষক জনাব টুনু মিয়া,  (২) ১ম সহকারী শিক্ষক শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দে,  (৩) ২য় সহকারী শিক্ষক শ্রী মানিক চন্দ্র সোম, (৪) ৩য় উর্দ্দু শিক্ষক মোঃ আপ্তাব উদ্দিন। পরবর্তীতে চৌকিদার ছবর শেখ।

৫/৬ মাস পর বিদ্যালয় পরিদর্শন হল। এদিন স্কুলে পরিদর্শন কি? দেখার জন্য ছোট বড় সকলে ভীড় জমান। পরিদর্শক সবকিছু ভাল পান। এ কারণে বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি প্রাপ্তি সহজ হয়, এবং তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার মুসলিম চৌধুরী প্রচুর সহযোগিতা করেন। সমগ্র এলাকা অর্থাৎ ফুলসাইন্দ, লক্ষনাবন্দ, নিজ ঢাকাদক্ষিন, নোয়াই দক্ষিনভাগ, মির্জানগর, ইন্নাতালীপুর গ্রামের লোকজনকে বর্তমান ২নং ফুলসাইন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (তৎকালীন প্রাইমারী নং১৯৩) নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়ন ১৭/০৪/১৯৬৩ ইং তারিখে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন বাবু শ্রী শশিমোহন দাস (ইউ.পি. সদস্য) এবং ঐ দিনই অন্যান্য সিদ্ধান্তের সাথে এ বছর থেকে অষ্ঠম শ্রেনী পর্যন্ত খোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ সময় বিদ্যালয়ের আয়ের উৎস ছিল কেবল মাত্র শিক্ষার্থীদের বেতন। শিক্ষার্থীদের বেতন দিয়ে শিক্ষক বেতনসহ অন্যান্য খরচ চালানো সম্ভব হতো না। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফসলি ধান সংগ্রহের। আমি ও ছোট বেলায় দেখেছি কোন সময় প্রধান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কোন সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী-চৌকিদারসহ ধান তুলতেন। এ ব্যাপারে আলাকার মানুষ ও পরিচালনা কমিটি প্রচুর সহযোগিতা করতেন। সরকারী নির্দেশ অনুসারে অথবা বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে বৃহত্তর এলাকার জনসাধারন সর্বপ্রথম ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেন ২৮/০৮/১৯৬৩ইং সালে।

ম্যানেজিং কমিটি গঠনের সভায় সভাপতিত্ব করেন মৌলভী মোতাহির আলী সাহেব। বিদ্যালয়কে সুন্দর সুষ্ঠু ও নিয়মের মধ্যে পরিচালনা করার জন্য যে সকল ব্যক্তিবর্গের উপর দায়িত্ব প্রধান করা হয় তারা হলেন- (১) জনাব মোঃ সফর আলী-  ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতিনিধি, (২) জনাব টুনু মিয়া- সেক্রেটারী/প্রধান শিক্ষক, (৩) জনাব মোঃ সমছুল হক- শিক্ষানুরাগী (ইউ.পি. চেয়ারম্যান), (৪) জনাব মোঃ ইছমত আলী- অভিভাবক প্রতিনিধি, লক্ষনাবন্দ (৫) জনাব মোস্তফা মিয়া- অভিভাবক প্রতিনিধি, নোয়াই দক্ষিনভাগ (৬)  বাবু শ্রী হরেন্দ্র কুমার দাস- অভিভাবক প্রতিনিধি, ফুলসাইন্দ (৭) জনাব ইজ্জাদ আলী- চাঁদা দাতাদের প্রতিনিধি, ফুলসাইন্দ (৮) বাবু বিনয় কুমার দে- শিক্ষক প্রতিনিধি।

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের পরিচালনায় বিদ্যালয় পরিচালনার যাত্রা শুরু হল। এখন দরকার শিক্ষার্থীর। প্রত্যেকের আত্মীয় স্বজনের ছেলে, মেয়ে বাড়িতে লজিং দিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হত। প্রায় বাড়িতেই বাইরের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে রাখা হত। এতে করে খুব অল্প সময়েই বিদ্যালয়ের পরিচিতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ এপ্রিল ১৯৬৩ সালে প্রথম সাধারন সভাতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সদস্যগণ নিজ নিজ এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের অত্র বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উৎসাহ প্রদান করবেন। ঐ সভাতেই সিদ্ধান্ত হল রিজার্ভ ফান্ড ও শিক্ষকদের বেতন প্রদানের জন্য ফসলী বোরো ধান এলাকা থেকে উত্তোলন করা। ঐ সময় ভর্তি রেজিষ্টার, সভা নোটিশ, মন্তব্যসহ প্রায় সকল কাগজ ইংরেজীতে লেখা হতো।

মানুষ গড়ার কারিগর, শিক্ষক মহোদয়গণের বেতন ০৬/০৫/১৯৬৩ইং সনে নির্ধারন করা হয় নিম্নরূপঃ

১। প্রধান শিক্ষক- জনাব টুনু মিয়া---------------------------------------------------- ১০০৳

২। প্রথম সহকারী শিক্ষক শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দে------------------------------------------৫০৳

৩। দ্বিতীয় সহকারী শিক্ষক শ্রী মানিক চন্দ্র সোম-------------------------------------৪০৳

৪। তৃতীয় উর্দ্দু শিক্ষক মোঃ আপ্তাব উদ্দিন--------------------------------------------৪০৳

৫। চৌকিদার ছবর শেখ--------------------------------------------------------------১৫৳

৩০/১২/১৯৬৩ ইং তারিখের সভায় শিক্ষার্থীদের বেতন  ও ফি নির্ধারিত হয় নিম্নরূপঃ

ষষ্ঠ শ্রেণি -----------৬.৫০৳

সপ্তম শ্রেণি ---------৮.৫০৳

অষ্টম শ্রেণি ---------৮.৫০৳

 

 ২নং ফুলসাইন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে গৃহে ক্লাশ করানো হতো, তাতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিদ্যালয়ের জন্য ভূমি দাতাদের খোঁজ করা শুরু হয়। ০৫/০৭/১৯৬৩ইং তারিখের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যারা ভূমি দান করার ওয়াদা  করেছেন তারা ভূমি দানপত্র করে দিতে। বিদ্যালয়ের জন্য জায়গা পছন্দ করেন নরাইটেকার রাস্তা সংলগ্ন পূর্ব সনকিত্তা।  বৃহত্তর এলাকার জনগণের ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিদার জন্য ঐ স্থান নির্ধারণ করা হয়। নতুন জায়গায় গৃহ নির্মাণ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদ্যালয় স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৬/১২/১৯৬৪ সালের সভায় ৪ ও ৫ নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬ই মার্চ ১৯৬৫ইং রোজ শনিবার নতুন স্থানান্তরিত স্কুল গৃহে দ্বারোৎপাঠন উৎসব হবে। নতুন স্কুল গৃহ নরাইটেকার রাস্তা সংলগ্ন পূর্ব ছনকিত্তায় স্থানান্তরিত হল। আগামী দিনে দেশও জাতির কল্যাণের কথা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের জন্য যে সকল মহৎপ্রা, উদার, দরদী ও দানশীল ব্যক্তি বিদ্যালয়ের ভূমি দান করেছেন, তাদের নাম- (১) জনাব হাজী মোঃ আকবর আলী, (২) জনাব ফজলুল হক, (৩) জনাব আব্দুল গফুর, (৪) জনাব মাসুকুর রব, (৫) জনাব শুনু মিয়া, (৬) জনাব শফর আলী, (৭) জনাব মখলিছুর রহমান, (৮) জনাব হাফিজ মোঃ আব্দুল মন্নান, (৯) জনাব ইছহাক মিয়া, (১০) জনাব মস্তকিম আলী, (১১) জনাব আনোয়ার আলী, (১২) জনাব ময়না মিয়া, (১৩) জনাব শরফ উদ্দিন সুরুজ, (১৪) জনাব আব্দুল খালিক। বিদ্যালয় ও খেলার মাঠসহ ২.৩৩ একর জমি দান করেন।